Home » Ghost Story – ভূতের গল্প » এক ভয়ংকর রাত (ভূতের গল্প)
–লাফসাডিও হিয়ার্ন
অনেক অনেক দিন আগে
জাপানের ছোট একটি
গায়ে বাস করত এক
গরিব চাষা এবং তার বউ।
তারা দুজনেই ছিল
বেজায় ভালোমানুষ।
তাদের অনেকগুলো
বাচ্চা। ফলে এতগুলো
মানুষের ভরণপোষণ
করতে গিয়ে নাভিশ্বাস
উঠে যেত চাষার। বড়
ছেলেটির বয়স যখন
চৌদ্দ, গায়ে-গতরে বেশ
বলিষ্ঠ, সে বাপকে
কৃষিকাজে সাহায্য
করতে নেমে পড়ল। আর
ছোট মেয়েগুলো হাঁটতে
শেখার পরপরই মাকে
ঘরকন্নার কাজে
সহযোগিতা করতে
লাগল।
তবে চাষি-দম্পতির
সবচেয়ে ছোট ছেলেটি
কোনো শক্ত কাজ
করতে পারত না। তার
মাথায় ছিল ক্ষুরধার
বুদ্ধি-সে তার সবকটা
ভাইবোনের মধ্যে
সবচেয়ে চালাক ছিল।
কিন্তু খুব দুর্বল শরীর
এবং দেখতে নিতান্তই
ছোটখাটো ছিল বলে
লোকে বলত ওকে দিয়ে
কোনো কাজ হবে না।
কোনো কাজেই লাগবে
না সে। বাবা-মা ভাবল
কৃষিকাজের মতো কাজ
করা যেহেতু ছোট
ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়
কাজেই ওকে
পুরোহিতের কাজে
লাগিয়ে দেওয়া যাক।
বাবা-মা একদিন ছোট
ছেলেকে নিয়ে গায়ের
মন্দিরে চলে এল। বুড়ো
পুরোহিতকে অনুনয়
করল, তিনি যেন
তাদের ছেলেটিকে
শিষ্য হিসেবে গ্রহণ
করেন এবং ওকে
পড়ালেখা শেখান। যাতে
বড় হয়ে সে মন্দিরে
যজমানি
(পুরোহিতগিরি)
করতে পারে।
বৃদ্ধ ছোট ছেলেটির
সঙ্গে সদয় আচরণ
করলেন। তাকে কিছু
কঠিন প্রশ্ন করা
হলো। ছেলেটি এমন
চতুর জবাব দিল যে
তাকে শিষ্য হিসেবে
গ্রহণ করতে কোনো
আপত্তি করলেন না
ধর্মগুরু। তিনি ওকে
মন্দিরের টোলে ভর্তি
করে দিলেন। ওখানে
ধর্ম শিক্ষা দেওয়া
হতো।
বৃদ্ধ পুরোহিত
ছেলেটিকে যা শেখালেন,
সবকিছু দ্রুত শিখে
নিল সে। সে গুরুর
অত্যন্ত বাধ্যগত
ছাত্র। তবে তার একটা
দোষ ছিল। সে পড়ার
সময় ছবি আঁকত। এবং
তার ছবির বিষয়বস্তু
ছিল বেড়াল। ওই সময়
মন্দিরে বেড়ালের ছবি
আঁকার ব্যাপারে নিষেধ
ছিল।
একা যখন থাকত
ছেলেটি, তখনই এঁকে
ফেলত বেড়ালের ছবি।
সে ধর্মগুরুর ধর্মীয়
বইয়ের মার্জিনে ছবি
আঁকত, মন্দিরের
সমস্ত পর্দা, দেয়াল এবং
পিলারগুলো ভরে
গিয়েছিল বেড়ালের
ছবিতে। পুরোহিত
বহুবার তাকে এসব ছবি
আঁকতে মানা। করেছেন।
কিন্তু কে শোনে কার
কথা! ছেলেটি ছবি
আঁকত কারণ না এঁকে
পারত না। ছবি না আঁকলে
কেমন
অস্থির লাগত
তার। সে ছিল অত্যন্ত
প্রতিভাবান একজন।
চিত্রকর। ছবি এঁকেই
একদিন নাম কামানোর
স্বপ্ন দেখত ছেলেটি। এ
জন্য
ধর্মশিক্ষায় মন
দিতে পারত না। ভালো
ছাত্র হবার খায়েশও
তার ছিল না। ভালো।
ছাত্র হতে হলে বই
পড়তে হয়। কিন্তু
পড়ার চেয়ে আঁকাআঁকিই
তাকে টানত বেশি।
একদিন এক দেবতার
পোশাকে বেড়ালের ছবি
আঁকতে গিয়ে ধর্মগুরুর
কাছে হাতেনাতে ধরা
খেল ছেলেটি। বুড়ো
খুবই রেগে গেলেন।
বললেন, তুমি এখনই
এখান থেকে চলে যাও।
তুমি কোনো দিনও
পুরোহিত হতে পারবে
না। তবে চেষ্টা। করলে
একদিন হয়তো বড়
মাপের চিত্রকর হতে
পারবে। তোমাকে শেষ
একটি উপদেশ দিই
শোনো। উপদেশটি
কখনো ভুলো না। রাতের
বেলা বড় জায়গা এড়িয়ে
চলবে; ঘুমাবে ছোট
জায়গায়!
গুরুর এ কথার মানে
কিছুই বুঝতে পারল না
ছেলেটি। এ কথার মানে
ভাবতে ভাবতে সে তার
ছোট বোঁচকা গুছিয়ে
নিয়ে বেরিয়ে পড়ল
মন্দির থেকে। গুরুকে
তাঁর কথার অর্থ
জিজ্ঞেস করার খুব
ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু
ধমক খাওয়ার ভয়ে
প্রশ্ন করল না। শুধু
বিদায় বলতে পারল।
মনে দুঃখ নিয়ে মন্দির
ছেড়েছে ছেলেটি।
কোথায় যাবে, কী করবে
বুঝতে পারছে না। যদি
বাড়ি যায়, পুরোহিতের
কথা না শোনার
অভিযোগে বাপ ওকে
বেদম পিটুনি দেবেন
তাতে কোনো সন্দেহ
নেই। তাই বাড়ি যাওয়ার
চিন্তা নাকচ করে দিল
সে। হঠাৎ পাশের বাড়ির
গাঁয়ের কথা মনে পড়ল।
এখান থেকে চার ক্রোশ
দূরে। ওই গাঁয়ে বিশাল
একটি মন্দির আছে।
মন্দিরে তরুণ-বুড়ো
অনেক পুরোহিত আছেন।
ছেলেটি শুনেছে ওখানেও
একটি টোল আছে।
সেখানে ধর্ম শিক্ষা
দেওয়া হয়। সে ঠিক
করল ওই গাঁয়ে যাবে।
মন্দিরের প্রধান
পুরোহিতের হাতে পায়ে
ধরে বসবে তাকে টোলে
ভর্তি করানোর জন্য।
ওর কাতর অনুরোধ
নিশ্চয় ফেলতে পারবেন
না পুরোহিত।
কিন্তু ছেলেটি জানত
না বড় মন্দিরটি বহু
আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।
ওখানে একটা পিশাচ এসে
আস্তানা গেড়েছে।
পিশাচের ভয়ে
পুরোহিতরা অনেক
আগেই মন্দির ছেড়ে
পালিয়েছেন। গাঁয়ের
কজন সাহসী মানুষ
পিশাচটাকে মারতে
গিয়েছিল। তারা এক
রাতে ছিল ওই মন্দিরে।
কিন্তু পরদিন কাউকে
জীবিত পাওয়া যায়নি।
তাদের রক্তাক্ত,
খাবলানো শরীর পড়ে
ছিল মন্দিরের চাতালে।
তারপর থেকে ভুলেও
কেউ ওই মন্দিরের ছায়া
মাড়ায় না। পরিত্যক্ত
মন্দিরটি এখন
হানাবাড়িতে পরিণত
হয়েছে। কিন্তু এসব
কথা তো আর ছেলেটি
জানত না। সে মন্দিরের
টোলে ভর্তি হওয়ার
আশায় পথ চলতে লাগল।
চার ক্রোশ পথ পাড়ি
দিয়ে গায়ে পৌঁছুতে
পৌঁছুতে সন্ধ্যা নেমে
এল। গ্রামের মানুষ
এমনিতেই তাড়াতাড়ি
ঘুমিয়ে পড়ে, মন্দিরে
পিশাচের হামলা হওয়ার
পর থেকে তারা সূর্য
পশ্চিমে ডুব না দিতেই
ঘরের দরজা এঁটে, বাতি
নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। আর
মন্দির থেকে ভেসে আসা
বিকট,
বীভৎস সব
চিৎকার শুনে শিউরে
শিউরে ওঠে।
মন্দিরটি গাঁয়ের শেষ
প্রান্তে, একটি টিলার
ওপরে। ছেলেটি মন্দিরে
আলো জ্বলতে দেখল।
ভুতুড়ে মন্দিরে কেউ
পুজো দিতেই যায় না,
আলো জ্বালা দূরে থাক।
তবে লোকে বলে
পিশাচটা নাকি
সাঁঝবেলা আলো জ্বেলে
রাখে পথ ভোলা
পথচারীদের আকৃষ্ট
করার জন্য। আলোর
হাতছানিতে দূর গাঁ
থেকে আসা মুসাফির
আশ্রয়ের খোঁজে
মন্দিরে ঢুকলেই
পিশাচের শিকার হয়।
ছেলেটি মন্দিরের
বিশাল, কারুকাজ করা
পুরু কাঠের দরজার
সামনে দাঁড়াল। আঙুলের
গাঁট দিয়ে টুক টুক শব্দ
করল। কেউ সাড়া দিল
না। আবার নক করল সে।
জবাব নেই। মন্দিরের
সবাই এত তাড়াতাড়ি
ঘুমিয়ে পড়ল নাকি!
অবাক হয় ছেলেটি। একটু
ইতস্তত করে দরজায়
ধাক্কা দিল সে।
ক্যাআআচ শব্দে মেলে
গেল কপাট। ভেতরে ঢুকল
ছেলেটি। মাটির একটি
প্রদীপ জ্বলছে কেবল।
কিন্তু কাউকে দেখা
যাচ্ছে না।
ছেলেটি ভাবল কেউ না
কেউ নিশ্চয় আসবে। সে
মেঝেতে বসে পড়ল।
অপেক্ষা করছে।
ছেলেটি লক্ষ করল
মন্দিরের সবকিছুই
ধুলোয় ধূসর হয়ে আছে।
মাকড়সার জালে ছেয়ে
গেছে প্রায় পুরোটা
জায়গা। বোঝাই যায়
অনেক দিন ঝাঁট
পড়েনি। হয়তো ঝাঁট
দেওয়ার লোক নেই।
ছেলেটি মনে মনে
আশান্বিত হয়ে উঠল
পুরোহিত তাকে শিষ্য
হিসেবে গ্রহণ করবেন
ভেবে। কারণ ঘর ঝাঁট
দেওয়ার জন্য হলেও তো
ওদের একজন লোক
লাগবে।
জানালায় বড় বড় পর্দা
ঝুলতে দেখে খুশি হয়ে
গেল ছেলেটি। বাহ্, ছবি
আঁকার চমৎকার
ক্যানভাস পাওয়া গেছে।
রঙ-পেন্সিলের বাক্স
সে সঙ্গেই নিয়ে এসেছে।
দ্বিরুক্তি না করে
বেড়ালের ছবি আঁকতে
বসে গেল।
পর্দাগুলো ভরে ফেলল
সে বড় বড় বেড়ালের
ছবিতে। পথ চলার
ক্লান্তিতে তার ঘুম
এসে গেল। সে পুঁটুলি খুলে
চাদর বিছিয়ে
মেঝেতেই শুয়ে পড়ার
তোড়জোর করছিল,
এমন সময় মনে পড়ে গেল
ধর্মগুরুর কথা : রাতের
বেলা বড় জায়গা এড়িয়ে
চলবে; ঘুমাবে ছোট
জায়গায়!
মন্দিরটি প্রকাণ্ড;
আর সে একা। গুরুর
কথাগুলো মনে পড়তে,
অর্থ না বুঝলেও, এবার
তার কেমন ভয় ভয়
করতে লাগল। সে
ঘুমানোর জন্য ছোট ঘর
খুঁজতে লাগল। ক্ষুদ্র
একটি কুঠুরিও পেয়ে
গেল। কুঠুরির দরজা
খুলে ভেতরে ঢুকল।
তারপর ছিটকিনি
লাগিয়ে শুয়ে পড়ল
মেঝেতে। একটু পরেই
ঘুমিয়ে গেল।
গভীর রাতে ভয়ংকর
একটা শব্দে জেগে গেল
সে। মারামারি করছে
কারা যেন। ফাঁচর্য্যাচ,
অপার্থিব আওয়াজের
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে
জান্তব চিৎকার। এমন
ভয় পেল ছেলেটি,
দরজার ফাঁক দিয়েও
মন্দিরের ভেতরে
তাকাতে সাহস পেল না।
তার। কেবলই মনে
হচ্ছিল তাকালেই এমন
ভয়াবহ কিছু একটা সে
দেখবে যে হার্টফেল
হয়ে যাবে। সে মেঝেতে
গুটিসুটি মেরে পড়ে
রইল। নিশ্বাস নিতেও
ভুলে গেছে।
আলোর যে সূক্ষ্ম রেখা
ঢুকছিল দরজার ছিলকা
দিয়ে তা হঠাৎ অদৃশ্য
হয়ে গেল। ছেলেটি
বুঝতে পারল নিভে
গেছে মন্দিরের বাতি।
নিকষ আঁধারে ডুবে গেল
ঘর। তবে ভীতিকর
শব্দগুলো চলল
বিরতিহীন। ফোঁস
ফোঁস নিশ্বাসের
আওয়াজ, রক্ত হিম করা
গলায় কে যেন আর্তনাদ
করে উঠছে মাঝে মাঝে।
গোটা মন্দির থরথর
করে কাঁপছে। বোঝা
যাচ্ছে দরজার বাইরে
মরণপণ লড়াইয়ে মেতে
উঠেছে দুটি পক্ষ।
অনেকক্ষণ পরে নেমে
এল নীরবতা। কিন্তু
ছেলেটি ভয়ে নড়ল না
এক চুল। অবশেষে ভোর
হলো। সোনালি আলো
দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে
পড়ল ক্ষুদ্র
প্রকোষ্ঠে।
লুকানো জায়গা থেকে
খুব সাবধানে বেরিয়ে
এল ছেলেটি। তাকাল
চারদিকে। দেখল
মন্দিরের মেঝেতে
রক্ত আর রক্ত! রক্তের
পুকুরের
মাঝখানে মরে
পড়ে আছে গরুর চেয়েও
আকারে বড় একটি
দৈত্যকার ইঁদুর।
মন্দিরের পিশাচ!
কিন্তু এটাকে হত্যা
করল কে? মানুষজন
কিংবা অন্য কোনো
প্রাণী দেখা যাচ্ছে ।
হঠাৎ ছেলেটি লক্ষ
করল সে গতরাতে
পর্দায় যেসব বেড়ালের
ছবি এঁকেছে, সবকটা
বেড়ালের গায়ে রক্ত
মাখা! সে তক্ষুনি
বুঝতে পারল পিশাচ
ইঁদুরটাকে তারই আঁকা
বেড়ালরা হত্যা করেছে।
এবং এখন সে বুঝতে
পারল বৃদ্ধ পুরোহিতের
সেই সাবধান বাণীর
মানে-রাতের বেলা বড়
জায়গা এড়িয়ে চলবে;
ঘুমাবে ছোট জায়গায়।
ওই ছেলেটি বড় হয়ে খুব
বিখ্যাত
চিত্রকর
হয়েছিল। আর তার আঁকা
বেড়ালের সেই ছবিগুলো
এখনো ওই মন্দিরে
আছে!