GolpoBD
বিচ্ছেদের সাক্ষী। - GolpoBD
Home » Sad Story – দুঃখের গল্প » বিচ্ছেদের সাক্ষী।
আজকেও নিহানের মা এসেছেন। এই নামিদামী স্কুলের বড়োলোক সব গার্জিয়ানদের ভীড়ে নিহানের মাকে আমার একটু অন্যরকম লাগে। চেহারাটা বেশ শান্ত শান্ত। যতোবার দেখেছি শাড়ি পরাই দেখেছি। সুতি না হয় বেশিরভাগ সময়ই সুন্দর সুন্দর তাঁতের শাড়ি। আজকাল কেউ এতো নিয়মকরে শাড়ি পরে বাচ্চার স্কুলে আসে না। আমি নিজেও না। শাড়ির সাথে বিশাল লম্বা চুলের বেনি। গলায় একটা চেইন আর হাতে আংটি। এই তার সাজসজ্জা। মেকাপ তো দূরের কথা ভুল করে ঐ গোলাপী ঠোটে কোনোদিন মনে হয় লিপস্টিকও দেন নাই। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের ওয়েটিং রুমে নিহানের জন্য অপেক্ষা করেন। নিহানের মায়ের এমন ঝটিকা সফর আমাকে বেশ কৌতুহলী করে তোলে। দুই হাত ভর্তি ব্যাগ থাকে। কী কী থাকে সেই ব্যাগের ভেতর আমার মাঝে মাঝে দেখার খুব ইচ্ছা হয়! তবে বুঝি সব খাবারের বক্স কিংবা প্যাকেট। ছুটির সময় ওয়েটিং রুমে বেশ ভীড় থাকে কিন্ত টিফিন পিরিয়ডে উনি ছাড়া আর কেউ আসেনই না বলতে গেলে! পুরো রুমে শুধু মা আর ছেলে! যেহেতু পাশেই আমাদের টিচার্স কমনরুম তাই দেখা হয়ে যায়। আর যখনই দেখা হয় ভদ্রমহিলা সালাম দিয়ে মুচকি হাসি দেন। আমিও হাসি। আর আমি দেখি নিহান আপনমনে খেয়েই যাচ্ছে। কোনোদিন বার্গার, কোনোদিন চকলেট ডোনাট আবার কখনো বা পিঠা। মহিলা অপ্রস্তুত হয়ে সলজ্জ আস্তে আস্তে বলেন - "ছেলেটা সকালে ঠিকমতো নাশতা করে নাই ম্যাডাম!" নিহান খেতে পছন্দ করে বোঝা যায়। তাই বলে মাকে নিজেই চলে আসতে হবে খাবার নিয়ে-কেমন কথা! মহিলা এতো কষ্ট করতে পছন্দ করেন! যা যা খাবার নিয়ে এসেছেন সেগুলোতো আসার সময় টিফিন বক্সেই দেয়া যায়। নাকি আমার দাদার মতো গরম গরম ফ্রেশ খাবার ছাড়া নিহান খেতে পারেনা?! দাদার প্রসংগ যখন এলো তাহলে বলি। আমার আম্মাকে দাদার জন্য তিনবেলা ফ্রেশ ফ্রেশ খাবার রান্না করতে হতো। দাদা ফ্রিজের খাবার একদমই খেতেন না। ভুল করেও না! রোজার সময় দেখতাম আম্মা ভোর রাতে উঠে কনকনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে রান্না করতেন। আরো হাসি লাগে মনে হলে আমি যখন পড়াশোনার জন্য ঢাকায় আসবো দাদার সে কী মন খারাপ! কেনো মন খারাপ? দাদার কথা হচ্ছে গরম গরম ভাত খেয়ে বাড়ির পাশের কলেজে যাইতি সেটাই ভালো ছিলো! নিহানকে দেখলে আজকাল আমার দাদার কথা মনে পড়ে! নিহানের মায়ের টিফিন পিরিয়ডে এমন আসা-যাওয়া নিয়ে একদিন আমাদের রুমা ম্যাডামের সাথে হেসে হেসে বললাম কেমন মহিলাটা বলেন তো?!। রুমা ম্যাডাম আগে নিহানদের ক্লাস টিচার ছিলেন। তখন নিহান ক্লাস থ্রিতে পড়তো। তিনমাস হলো নিহান ক্লাস ফোরের ছাত্র আর আমি তার নতুন ক্লাস টিচার। আমার কথায় ম্যাডাম চমকে ওঠেন 'ওহ আপনি জানেন না ম্যাডাম!?' আমিতো সত্যি কিছু জানিনা। আমার হাসি হারিয়ে যায়। নিহানের বাবা-মা'র নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে! সেই প্রায় এক বছর হলো... নিহান বাবার কাছে থাকে। নিহানের ছোটো একটা বোনও আছে। সেও বাবার সাথে। মায়ের সাথে বাচ্চাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না, দেখা করতে দেওয়া হয় না! যোগাযোগ সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন! তাই নিহানের মা স্কুলে এসে দেখে যান ছেলেকে! স্কুল ছুটির পর গাড়ির ড্রাইভার আসে, তাকেও দেখা দিতে চান না মহিলা, তাই এই লুকোচুরি! তাছাড়া অনেক গার্জিয়ান থাকে কখন কে দেখে ফেলে আবার বাসায় খবর পৌঁছে যায় যদি! তাই বাচ্চার টিফিন পিরিয়ডে স্কুলে এসে নিজ হাতে খাইয়ে দেন, প্রানভরে দেখে যান... হয়তো সংকোচ বোধ করেন বলতে তিনি আর নিহানের বাবা একসাথে থাকেন না। এজন্য প্রতিদিন সেই একই কথা 'ছেলেটা সকালে ঠিকমতো নাশতা করে নাই ম্যাডাম!" এরপর থেকে নিহানের মা এলে আমার বুকের ভেতরটা কেমন আনন্দে ভরে যায়! আমি আরো মনোযোগ দিয়ে মা-ছেলের সময়টা দেখি! কতোবার যে চুমু দেন, মাথায় -কপালে হাত বুলিয়ে দেন... নিহানও মায়ের পাশে কেমন লেপ্টে থাকে... আহা! কী আবেগময় সেই দৃশ্য! আমারও চোখ ঝাপসা হয়ে আসে... আমি চাই নিহানের মা প্রতিদিনই আসুক! হঠাত হলো কী নিহান আজ চারদিন হলো স্কুলে আসছে না। নিহানের বাবার নাম্বারে কল দিয়েছি কয়েকবার কিন্তু ফোন রিসিভ করেন নাই। আমার ভিতরে ভিতরে একটু টেনশন হচ্ছে! কী হলো বাচ্চাটার?! নিহানের মাকেও দেখছি না। মহিলা সপ্তাহে দু একবার আসেন কিন্তু এই সপ্তাহে একবারও আসেন নাই। কতো কল্পনা করে ফেললাম আচ্ছা মা-ছেলে হারিয়ে গেলো নাকি কোথাও!? ইচ্ছে করে!? একসাথে?! গেলেই ভালো! অবশেষে আজ ইশতিয়াক সাহেবের দেখা পেলাম।সুট- টাই পরা সুদর্শন এক ভদ্রলোক। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুম থেকে বের হচ্ছেন। জি, তিনিই নিহানের বাবা। খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে আছেন মনে হলো। আমি শুধু পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলাম নিহান ভালো আছে তো? তিনি হেসে উত্তর দিলেন' জী ম্যাডাম ভালো আছে। চিন্তা করবেন না...।' তারপরের সপ্তাহের কথা... স্কুল ছুটি হয়েছে। বাসায় যাবো। কী বাতাস চারিদিকে! আকাশ কালো হয়ে আছে। অনেক বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। ভুলে আজও ছাতাটা নিয়ে আসি নাই। বৃষ্টি হওয়ার আগে বাসায় পৌঁছালেই হয়। হঠাত মনে হলো অনেকদিন নিহানের মাকে দেখি না। মনে মনে তাঁকে আমি খুঁজি। ভালো আছেন তো তিনি? ভাবতে ভাবতেই দেখি আমার সামনে নিহানের মা দাঁড়িয়ে! চেহারাটা কেমন যেনো লাগছে! ফ্যাকাশে! "আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম ভালো আছেন?' সেই চিরচেনা হাসি। আমিও মাথা নাড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম অসুস্থ নাকি? জানালেন টাইফয়েড হয়েছিলো তাই আসতে পারেন নাই। এদিক সেদিক উঁকি দিয়ে বললেন ম্যাডাম আমি আপনাকেই খুঁজচ্ছিলাম। সেই টিফিন পিরিয়ডে এসেছি কিন্তু ভিতরে যেতে পারি নাই। আজকে নিহানের জন্মদিন তাই সারপ্রাইজ দিতে এসেছি! আমি দেখলাম এই অসুস্থ শরীরেও তিনি আজ সিল্কের সবুজ আর লাল একটা শাড়ি পরেছেন। চোখে হালকা কাজল। আজ বেনী করেন নি, সুন্দর একটা খোঁপা করেছেন। ছেলের জন্মদিনের আয়োজন করে এসেছেন। এই সাজসজ্জা তার অসুস্থ শরীর ঢাকতে পারেনি। কেমন দুর্বল লাগছে! এক হাতে টেস্টি ট্রিট এর প্যাকেট। হু, কেকই হবে ভিতরে। আরেকটা ব্যাগে আরো কিছু খাবারের প্যাকেট। আমি মহিলাকে দেখেই যাচ্ছি। কী সুন্দর একজন মা! "ম্যাডাম, নিহান কোথায়? একটু ডেকে দিবেন প্লিজ!" 'আপা, ইশতিয়াক সাহেব গত সপ্তাহে এসেছিলেন স্কুলের টিসি নিতে...' 'টিসি মানে!? স্কুল চেঞ্জ করবে?" আমি অবলীলায় বলে দিলাম 'আপা, ইশতিয়াক সাহেব গতকাল সপরিবারে কানাডা চলে গেছেন। ওখানেই স্থায়ীভাবে থাকবেন.... " আমি আর কথা বলতে পারলাম না... আর কথা বলার সাহসও হলো না... নিহানের মা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানতে চাইনা ইশতিয়াক সাহেব আর তার স্ত্রীর মধ্যে কি হয়েছিলো... আমি জানতে চাইনা কেনো তাদের পক্ষে আর একসাথে থাকা সম্ভব হয়নি... আমি শুধু জানতে চাই কেনো সন্তানগুলো মা থাকা সত্ত্বেও মা হারা হলো!? কেনো ছোট্ট নিহান আর তার বোন মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হলো? কী তাদের অপরাধ?! কেনো এই শাস্তি? নিহান কি আর কখনো তার মাকে দেখতে পারবে না? নিহান কি ভুলে যাবে? নাকি বড়ো হয়ে মাকে খুঁজতে চলে আসবে এই দেশে? এই নিহান কি কোনোদিন জানবে তার জন্মদিনে তার মা কেক নিয়ে ছেলেকে চমকে দিতে স্কুলে এসেছিলো? হঠাত দমকা হাওয়ায় বৃষ্টি শুরু হলো... এমন বৃষ্টি মনে হলো কোনোদিন দেখিনি... এই বৃষ্টির প্রতিটি কনা গায়ে লাগছিলো বারুদের মতো... আর এই বৃষ্টির ফোঁটাতেই নিহানের মায়ের চোখের কাজল গড়িয়ে পরছে.... তাঁর সদ্য কেনা সবুজ-লাল সিল্কের শাড়িটা ভিজে যাচ্ছে... তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একা। কেউ তাকে দেখে ফেলার ভয় নেই আর বানিয়ে বানিয়ে অসত্য কথা বলার দিন নেই... তিনি আজ সত্যি একা... নাড়ির বাঁধন ছিড়ে গেছে দ্বিতীয়বারের মতো... মা-ছেলের এই বিচ্ছেদের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি... আজ থেকে নিহানের মা আর স্কুলে আসবেন না... খাদিজা তুল কোবরা কাব্য মালাবী, ইষ্ট আফ্রিকা ২৩ অক্টোবর, ২০২২
Share:

Story Info:

Writer: Ariyan Islam
Date: 24-10-2022
Comment: 0
No Comment !
Name:

Text:

Smilies List